ট্রান্সজেন্ডার হওয়া কি জন্মগত বিষয়?
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—ট্রান্সজেন্ডার শনাক্তকরণে কোনো মেডিক্যাল পরীক্ষানিরীক্ষা নেই (যেমন: ডায়াবেটিস পরীক্ষার মতো), কেননা এটি মনের ইচ্ছাধীন (self-identified) এবং কিছু প্রশ্নমালার (Questionnaire) ওপর জরিপ করে শনাক্ত করা হয়।
মানুষের লিঙ্গ-পরিচয় তথা নারী বা পুরুষ নির্ধারণে সুস্পষ্ট একটি জৈবিক জেনেটিক ভিত্তি রয়েছে। এক্ষেত্রে ছেলেদের ক্রোমোজোম হলো XY, আর মেয়েদের ক্রোমোজোম XX। এখানে মূল পার্থক্য হচ্ছে Y ক্রোমোজম, আরও নির্দিষ্ট করে বললে—একটিমাত্র জিন (যা SRY নামে পরিচিত) ছেলে অথবা মেয়ে লিঙ্গধারী হবে কিনা তা নির্ণয় করে। এ জন্য এই জিনকে ‘মাস্টার সেক্স রেগুলেটর’ তথা ‘ছেলেমেয়ে হওয়ার মলিকিউলার সুইচ’ বলা হয়। সুইচটি যদি সক্রিয় হয়, তবে ভ্রূণটি ছেলে হবে। আর যদি সেই SRY জিন কোনো কারণে নষ্ট বা নিষ্ক্রিয় থাকে, তবে ভ্রূণটি হবে মেয়ে। জেন্ডার পরিচয় (মনের ইচ্ছানুযায়ী যৌন পরিচয়) নির্ণয়ে এমন কোনো জেনেটিক ভিত্তি নেই, অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট কোনো জিন বা জেনেটিক মার্কার গত ২০-৩০ বছর শত চেষ্টা করেও বের করা সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, লিঙ্গ পরিবর্তন বা sex change নিয়ে ফিশ মডেলে অনেক গবেষণা হয়েছে। এই রিসার্চ ফিল্ডে আমি পিএইচডি করেছি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে। আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল—জেব্রাফিশ (খুব পপুলার রিসার্চ মডেল) কীভাবে মেয়ে থেকে ছেলে মাছে রূপান্তরিত হয়। আমার পিএইচডি থিসিস পেপার (Molecular Analyses of Gonad Differentiation and Function in Zebrafish) গুগল সার্চ করে পড়া যাবে। এই ফিশের মানুষের মতো সুনির্দিষ্ট সেক্স ক্রোমোজোম নেই। জন্মের এক পর্যায় পর্যন্ত (প্রথম ৩ সপ্তাহ) সব জেব্রাফিশ মেয়ে হিসেবে বড় হয় এবং এর পরে কিছু অপরিপক্ব মেয়ে (Juvenile Zebrafish) ফিশ ছেলেতে রূপান্তরিত হয়। আমার কাজ ছিল মলিকিউলার লেভেলে আসলে কী ঘটে, সেই রহস্য উন্মোচন করা। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে জিনে (Gene) সমস্যা থাকলে একজন মানুষ হিজড়া হতে পারে, সেই জিনটি জেব্রাফিশ থেকে প্রথম ক্লোনিং করে তার বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য এনালাইসিস (Zebrafish Androgen Receptor: Isolation, Molecular, and Biochemical Characterization) করেছিলাম, যা ভালো জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। মাছের পোনাকে হরমোন দিয়ে ছেলে বা মেয়েতে পরিবর্তন করা যায়। তেলাপিয়া মাছ চাষে এটি বহুল পরিমাণে ব্যবহার হয়, কেননা তেলাপিয়ার সুনির্দিষ্ট সেক্স ক্রোমোজোম নেই। মাছে হরমোন প্রয়োগ করে ভিন্ন লিঙ্গে রূপান্তর করা হলে, সেগুলো প্রজননশীল হতে কোনো সমস্যা হয় না। অর্থাৎ মাছগুলো পরিপূর্ণভাবে ভিন্ন লিঙ্গে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডাররা (ট্রান্সসেক্সুয়াল) হরমোন থেরাপি বা সার্জারি করে ছেলে থেকে মেয়ে অথবা মেয়ে থেকে ছেলেতে রূপান্তরিত হতে পারলেও তাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের কোনো পরিবর্তন হয় না। বাহ্যিক অঙ্গকে (যেমন: নারী-যৌনাঙ্গ) কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে পুরুষাঙ্গের মতো করে তৈরি করা হলেও সেই মহিলা বন্ধ্যা হয়ে যায়, অর্থাৎ শিশু জন্মদানে সে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। আর এই সেক্স রিডিজাইন সার্জারি কেবল মনের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য হলেও এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। মানুষের ক্ষেত্রে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু মিলনের ফলে যে প্রথম কোষ তৈরি হয় (জাইগোট), সেই কোষেই একজন মানুষের লিঙ্গ নির্ধারিত হয়ে যায়। অর্থাৎ এটি অত্যন্ত পারফেক্ট একটি জৈব-প্রক্রিয়া।
ট্রান্সজেন্ডাররা একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছিল যে, তাদের জেন্ডারও জন্মগতভাবে গর্ভাবস্থায় নির্দিষ্ট হয় (‘Born this way’ hypothesis)। অবশেষে গে জিন আবিষ্কার হলো, এই নিয়ে ১৯৯৩ সালে বিশ্বমিডিয়ায় হলো তোলপাড়। এলজিবিটির জেনেটিক ভিত্তি পাওয়া গেল বলে সে কী উন্মাদনা! আনন্দের অতিশয্যে আমেরিকার NATIONAL GAY & LESBIAN TASK FORCE বিবৃতি দিলো—the NIH study… shows that homosexuality is a naturally occurring and common variation among humans…”।(“NGLTF Statement on NIH Genetic Study on Homosexuality,” n.d.) পরবর্তী সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জেনেটিক ডাটা এনালাইসিস করে সায়েন্টিফিক মহল সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ‘গে জিন’ বলে কিছুই পাওয়া যায়নি, জেনেটিক বৈচিত্র্যতা বা ভিন্নতা দিয়ে হোমসেক্সুয়ালিটি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
নিউরোবায়োলজিক্যাল (ইমেজিং টেকনোলোজি) গবেষণার মাধ্যমে নারী এবং পুরুষের মস্তিষ্কে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া গেলেও জন্মগত ট্রান্সজেন্ডার বা এলজিবিটি দাবি করার মতো অগ্রগতি নেই। ট্রান্সজেন্ডারদের সেই ‘Born this way’ (‘এভাবেই তারা জন্মগ্রহণ করে’) হাইপোথিসিস প্রমাণে ভ্রূণ পর্যায়ে কোনো হরমোনগত পার্থক্য বা ভিন্নতা দেখা যায় কিনা, তা নিয়ে ইন্টারসেক্স (হিজড়া) শিশুদের ওপর পর্যাপ্ত রিসার্চ করেও ভিত্তি দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। এত প্রচেষ্টার পরও ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার কারণ যেহেতু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই এটি নিয়ে বেশি মরিয়া হলে কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির জন্য ভালো হবে না বলে বিখ্যাত সায়েন্টিফিক ম্যাগাজিন ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ এই শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপে—“The Search for a ‘Cause’ of Transness Is Misguided”—অর্থাৎ ট্রান্সজেন্ডারের কারণ খোঁজা বিপথগামিতার নামান্তর।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—ট্রান্সজেন্ডার শনাক্তকরণে কোনো মেডিক্যাল পরীক্ষানিরীক্ষা নেই (যেমন: ডায়াবেটিস পরীক্ষার মতো), কেননা এটি মনের ইচ্ছাধীন (self-identified) এবং কিছু প্রশ্নমালার (Questionnaire) ওপর জরিপ করে শনাক্ত করা হয়।