‘তৃতীয় লিঙ্গ’ কোটা- চাকুরীতে বৈষম্য এবং সমকামিতার সামাজিকীকরন?
তৃতীয় লিঙ্গের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ না করে হলে আইনের ফাঁকফোকর গলে ভবিষ্যতে সমকামিতা লিগাল হয়ে যেতে পারে। তাই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সরকারকে গুরুত্ব দেয়া উচিত যাতে কেউ সুযোগ না নিতে পারে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত-সংষর্ষের কারনে অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় আপিল বিভাগ মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ কোটা বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে যা একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কোটার ১ শতাংশ নির্ধারন করা হয়েছে প্রতিবন্ধী এবং তৃতীয় লিঙ্গ গোষ্ঠীর জন্য। এখানে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে যে তৃতীয় লিঙ্গকে আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে যার আইনগত সংজ্ঞা (Legal definition) এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়নি। সংজ্ঞার অস্পষ্টতার সুযোগে চাকুরীতে বৈষম্য তৈরীর হবে এবং দেশের সমাজ ও আইন বিরোধী (প্যানেল কোড ৩৭৭) সমকামিতার পথ উন্মোচন হতে পারে। বিশ্ব গণমাধ্যমে (আল জাজিরা, বিবিসি) তৃতীয় লিঙ্গের কোটার ঘোষণাকে ট্রান্সজেন্ডার কোটা হিসেবে প্রচার করেছে।
তৃতীয় লিঙ্গ গোষ্ঠীর মানুষ কারা?
বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের লিগ্যাল ডেফিনেশন না থাকলেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে,-
“২০১২-১৩ অর্থ বছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে হিজড়াদের বিষয়ে কিছু কাজ শুরু হয়। তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জনাব এনামুল হক মোস্তফা শহীদ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য একটি নতুন ভাবনা উন্নয়নের জন্য একটি ব্যতিক্রমী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এরপর হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য একটি জরিপ কাজ শুরু হয় । সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এই জরিপ কাজ সম্পন্ন হয়। এতে দেখা যায় বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা প্রায় ৯২৮৫ জন। ওই সময়ে যে সকল এনজিও হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছিল তাদের কাছ থেকেও হিজড়াদের জীবনধারা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায় । তাদেরকে কিভাবে মূলধারায় আনা যায়, সে বিষয়ে সংশিষ্ট বেসরকারি সংস্থা এবং হিজড়াদের নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে কয়েকটি স্টেকহোল্ডার মিটিং করা হয়। সে সময় হিজড়া প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সাথে মতবিনিময়ে জানা যায়, তারা হিজড়া নামে কোথাও কোন কিছু করতে পারে না। হিজড়া হিসেবে তাদের কোন স্বীকৃতি নেই। তাদের পাসপোর্ট বা ভোটার আইডি কার্ড করার ক্ষেত্রে তাদেরকে নারী বা পুরুষ লিখতে হয়। যেহেতু হিজড়াদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন স্বীকৃতি ছিল না সেহেতু হিজড়া হিসেবে তাদের পরিচয় পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে এই সংকট ছিল ।
তখন এই অবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে একটি সারসংক্ষেপের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ তাদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রানজেন্ডার বা রূপান্তরকামী এর কোনোটিতেই নিজেদের লিঙ্গ স্বীকৃতি চাচ্ছিল না। তারা নিজেদেরকে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করছে এবং সে ভাবেই তাদের দাবি উত্থাপন করে। হিজড়াদের অভিপ্রায় অনুযায়ী সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিকট প্রস্তাব প্রেরণ করা হলে মন্ত্রণালয় থেকে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয। ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর হিজড়া জনগোষ্ঠীকে “হিজড়া লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করে স্বীকৃতি প্রদান সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি, রবিবার বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ।“ তথ্যসূত্র : সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার (হিজড়া শব্দকোষ, পৃষ্ঠা ১৬০-১৬৩)।
শরীফার ইস্যুতে বিতর্ক- হিজড়া বনাম ট্রান্সজেন্ডার
পাঠ্যপুস্তকে তৃতীয় লিঙ্গ তথা অবহেলিত হিজড়াদের মোড়কে ট্রান্সজেন্ডারবাদ শরীফার গল্পের (মনে মনে নারী বা পুরুষ) মাধ্যমে অন্তর্ভূক্ত করার কারণে কয়েকমাস আগে দেশে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। হিজড়া (লিঙ্গ প্রতিবন্ধী) এবং ট্রান্সজেন্ডার (শারীরিকভাবে সম্পূর্ন সুস্থ, কিন্তু মানসিকভাবে নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের মনে করে) যে এক বিষয় নয় তা নিয়ে প্রতিবাদ করায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আসিফ মাহতাবকে চাকুরীচ্যুত করা হয় এবং আরেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককেও (হিজড়া-ট্রান্সজেন্ডার বিশেষজ্ঞ) উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিডিয়ায় ‘জঙ্গি’ ট্যাগের মাধ্যমে চাকুরীচ্যুত করতে চেষ্টা করা হয়। এমন অনৈতিক আচরণের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে।
মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে নতুন কারিকুলাম প্রনয়নে এনজিও গোষ্ঠী ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে যা নিয়ে গনমাধ্যমে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে লিংগ/যৌন বৈচিত্র্য তথা এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) অধিকার নিয়ে আইসিডিডিআরবি (আন্তর্জাতিক এনজিও) এবং বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ায়ার সোস্যাইটিসহ কিছু এনজিও ২০০৭ সাল থেকে ব্যাপক কাজ শুরু করেছে[1]। সেই লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করে ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট পাবলিক স্কুল প্রকাশ্যে এলজিবিটি/সমকামী অধিকার দাবী করে। ব্র্যাকসহ এলজিবিটি গোষ্ঠী সমকামিতা অপরাধ আইন (৩৭৭) বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল[2]। সমকামী অধিকার কর্মকান্ডের বিস্তারিত বিবরণ ব্র্যাকের গবেষকরা জার্নাল আর্টিকেল হিসেবে প্রকাশ করে ২০১১ সালে। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে- “Creating a public space and dialogue on sexuality and rights: a case study from Bangladesh” শিরোনামে প্রকাশিত জার্নাল আর্টিকেল গুগল সার্চ করে পড়তে পারেন[1]।
লিঙ্গবৈচিত্র্য গোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকে শরীফার গল্পের মোড়কে ট্রান্সজেন্ডারবাদ সম্পর্কে ধারনা দেয়া হয়। ব্র্যাকসহ অন্যান্য এনজিও হিজড়াকে সংস্কৃতি বিবেচনা করে, লিঙ্গ প্রতিবন্ধী মনে করে না। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ডকুমেন্ট অনুসারে,-
“বাংলাদেশে যারা হিজড়া হিসাবে পরিচিত তাদের বেশিরভাগই পুরুষ এবং (পূর্ণাঙ্গ) পুরুষ যৌনাঙ্গ নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু তাদের মন মানসিকতা একজন নারীর মতই এবং মানসিকভাবে তারা নিজেদেরকে মনে করেন নারী। আমাদের সমাজে হিজড়াদের সম্পর্কে বেশ কিছু ভুল ধারনা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ ভাবে যে হিজড়াদের যৌনাঙ্গই নেই; বা যৌনাঙ্গের পরিবর্তে তাদের একটি ছোট গর্ত আছে; বা তাদের অঙ্গ অসম্পূর্ণ।…
… হিজরা সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক ইন্টারসেক্স (জন্মগত সমস্যা তথা আসল হিজড়া) ব্যক্তিও রয়েছে। এ ধরনের মানুষ অসম্পূর্ণ যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন অথবা তাদের কারো কারো পুরুষ এবং মহিলা উভয় প্রকারের যৌনাঙ্গই থাকে। যেমন একজন ব্যক্তির ক্লিটোরিস থাকতে পারে কিন্তু হয়ত তার যৌনাঙ্গর মুখ খোলা নেই এবং তার একটি অসম্পূর্ণ ছোট লিঙ্গও আছে। সব ইন্টারসেক্স মানুষকে হিজড়া বলা যায় না যতক্ষণ না ব্যক্তি নিজেকে হিজড়া হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন (অর্থাৎ গুরু অধীনে থেকে ভিক্ষা পেশায় জড়িত হতে হবে)।“ – তথ্যসূত্র ‘চলো ভুল ধারণাগুলো ভেঙে ফেলি, Breaking the same project [3]
২৫ বছর কাজ করা বন্ধু সোস্যাল এনজিও এর জনসংযোগ ও যোগাযোগ কর্মকর্তা সম্প্রতি হিজড়া সংস্কৃতি নিয়ে পত্রিকায় আর্টিকেল-এ মন্তব্য করেন[4]—
“কালের বিবর্তনে এই হিড়জা সংস্কৃতি বা চর্চা (খেয়াল করুন- হিজড়াকে সংস্কৃতি হিসেবে দেখানো হয়েছে!) একটি সাম্রাজ্যবাদী পেশায় পরিণত হয়েছে। এখন গুরুদের ভূমিকা রাজার মতো, তাদের মন্ত্রী-উপমন্ত্রী (সম্মান ও মর্যাদা ভেদে বিভিন্ন পদ আছে) সবই আছে। সাম্রাজ্য বাড়ানোর মতো তাদের এলাকা দখলের লড়াই আছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আছে। নতুনদের শিষ্যত্ব প্রদান করেই তাদের মাঠে নামিয়ে দেন টাকা তোলার জন্য, আর এই কাজের বিনিময়ে শিষ্যরা কেবল পেটে-ভাতে বাঁচতে পারে আর বিত্তবৈভবে বড় হতে থাকে গুরু (রাজা) ও তার নৈকট্যভাজনরা (মন্ত্রিপরিষদ)।“
হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার যেভাবে একাকার হয়ে গেল!
ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিন এশিয়ার সাধারন মানুষ হিজড়া বলতে লিঙ্গ প্রতিবন্ধী মনে করে। এই অঞ্চলে হিজড়াদের রয়েছে দুই হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস। তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজচ্যুত করা হয় ব্রিটিশ আমলে। ১৯৯৭ সাল থেকে আইসিডিডিআরবি এবং বন্ধু সোস্যাল এনজিও এর মাধ্যমে সমকামী পুরুষদের (MSM, Man sex with man) স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার প্রকল্প শুরু হয় পশ্চিমা অর্থায়নে[5]। সমকামী পুরুষদের নিয়ে এইচআইভি প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে বাই-প্রডাক্ট হিসেবে জানা গেল সমাজের পরিচিত হিজড়ারা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী নয় এবং তারা সমকামী যৌন পেশায় জড়িত। হিজড়াদের যৌন আচরণ নিয়ে আইসিডিডিআরবি নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণা করে যা পলিসি বয়ানে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়[5]। জার্নাল নিবন্ধ এবং পলিসি পেপারগুলিতে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার সম্পূর্ণ আলাদা পরিভাষা হলেও শব্দ দুটিকে সমার্থক [Transgender (Hijra)] হিসেবে দেখানো হচ্ছে প্রায় ২০ বছর ধরে[6]।
এনজিওরা যেহেতু হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে কাজ করছে, তাই হিজড়ার প্রচলিত সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে ট্রান্সজেন্ডার সামাজিকীকরণে। সকল হিজড়ারা ট্রান্সজেন্ডার নারী, কিন্তু সকল ট্রান্সজেন্ডার নারী হিজড়া নয়। ব্র্যাকসহ সব এনজিও এর মতে হিজড়ারা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী নয়, বরং এটাকে একটা সংস্কৃতি বিবেচনা করে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী হিজড়া হতে হলে তাদের রীতি-নীতি (যেমন হিজড়াগিরি তথা ভিক্ষা করা, গুরুর অধীনে বাস করা) মানতে হবে[7]। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হিজড়ার ব্যানারে ট্রান্সজেন্ডাদেরকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:
- উচ্চশ্রেনীর ট্রান্সজেন্ডার : এরা দলবদ্ধভাবে ঢেরায় বাস করে না, হিজড়াগিড়িও করে না। এরা অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলকভাবে অবস্থাসম্পন্ন এবং এনজিও এবং সুশীল সমাজের মদদপুষ্ট। পড়াশোনা এবং চাকরির বাজারে এই ট্রান্সজেন্ডার বিশেষ সুবিধা ভোগ করা শুরু করেছে। এদেরকে ‘এনজিও হিজড়া’-ও বলা যেতে পারে।
- নিম্নশ্রেনী ট্রান্সজেন্ডার : এরা হিজড়া কালচারে অভিযোজিত ট্রান্সজেন্ডার। অর্থাৎ এই ধরনের ট্রান্সজেন্ডাররা হিজড়া মহল্লায় বাস করে হিজড়াগিরি করে। এরা অশিক্ষিত ও গরিব।
হিজড়া বনাম ট্রান্সজেন্ডার- মেডিকেল টেস্ট বিতর্ক
হিজড়াদের স্বীকৃতি দেয়ার পর তাদের পূনর্বাসনের জন্য সরকার কিছু প্রকল্প গ্রহণ করে। তাদের চাকুরীর দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হয়। সত্যিকারের হিজড়ারা যেন সুযোগ পায় সেজন্য হিজড়া শনাক্তকরণে মেডিকেল পরিক্ষা করা হয়। টেস্টে দেখা যায় ১২ জনই সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ (এদের ১১ জনের লিঙ্গ এবং অন্ডকোষ আছে, একজনের লিঙ্গ সার্জারী করা ছিল)। অবশেষে তাদের চাকুরী দেয়ার পরিকল্পনা বাতিল করা হয় (১ জুলাই ২০১৫, বিবিসি)।
এই ঘটনায় দেশের এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তোলপাড় হয়। তাদেরকে মেডিকেল টেস্ট করার মাধ্যমে অপমান করা হয়েছে, মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছে বলে বিবৃতি দেয় এনজিও সংস্থাগুলো। দুটি মানবাধিকার সংগঠন হিজড়া শনাক্ত করেন মেডিকেল টেস্ট বাদ দিতে কোর্টে দাবী জানায় (০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ঢাকা ট্রিবিউন)। উল্লেখ্য যে, মেডিকেল, বুয়েট, আর্মিতে যোগদানের জন্য মেডিকেল টেস্ট বাধ্যতামূলক। এটা নিয়ে কিন্তু মানবাধিকার লংঘনের প্রশ্ন তোলা হয় না।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- ট্রান্সজেন্ডার শনাক্তকরণে কোন মেডিকেল টেস্ট নেই। এটা সম্পূর্ণই মানসিক ব্যাপার, কোন হরমোনের তারতম্যও ঘটে না।
তৃতীয় লিঙ্গের পশ্চিমা ধারনা
বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে বর্ণিত কওমে লুতের সমকামিতা ইস্যুর প্রায় চার হাজার পর আধুনিক সমকামী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ জার্মানীর কার্ল হাইনরিখ উলরিখস ২৯ আগষ্ট, ১৮৬৭ সালে মিউনিখে অনুষ্ঠিত জার্মান আইনজ্ঞদের এক সম্মেলেনে সমকামিতা অপরাধ আইনের (প্যারাগ্রাফ ১৭৫) বাতিল করার দাবী জানান[8]। তিনি জোর দিয়ে বলেন এই আইনের কারণে প্রাকৃতিক ‘যৌন তাড়না’ চরিতার্থ করার জন্য কিছু মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। উলরিখস নিজে সমকামী ছিলেন এবং সমলিঙ্গের বিকৃত যৌনতাকে জন্মগত এবং প্রাকৃতিক তথা সহজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, যেহেতু এটা প্রাকৃতিক, তাই এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, কারোর জন্মের উপর হাত নেই [9]। তিনিই সর্বপ্রথম তৃতীয় লিঙ্গের তাত্ত্বিক ধারনা দেন যার উপর ভর করে গড়ে উঠে আজকের এলজিবিটি অধিকার আন্দোলনের পটভূমি।
তৃতীয় লিঙ্গ ধারনা– উলরিখস মনে করতেন সমকামীরা একটি স্বতন্ত্র শ্রেণীর মানুষ (অর্থাৎ পরিচয়), যারা জন্মগতভাবেই বিষমকামী/অসমকামী (নারী ও পুরুষ) থেকে আলাদা। সেই সময়ে এই শ্রেণীর মানুষদের বর্ণনা করার কোনো শব্দ ছিল না, শুধু নেতিবাচক, আচরণ-ভিত্তিক “সডোমাইট” শব্দটি ছিল। তাই উলরিখস “আরনিং” শব্দটি প্রবর্তন করেন। পরে হাঙ্গেরিয়ান কার্ল মারিয়া কের্টবেনি “সমকামী” শব্দের প্রচলন করেন। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে শরীর ও মনের যৌন বিকাশ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, ফলে হয় তারা পুরুষ নয়তবা নারী। কিন্তু যেসব ভ্রূণ “আরনিং” হিসেবে বেড়ে উঠে তাদের শারীরিক বিকাশ পুরুষের মতো হলেও মানসিক বিকাশ নারীর মতো হয় (Female trapped in a male body)। অর্থাৎ শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ পুরুষ হলেও তারা মনে মনে নারী। এই ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ পুরুষ বা সম্পূর্ণ নারী না হওয়ায় তারা একটি “তৃতীয় লিঙ্গ”গঠন করে[9]।
পরবর্তীতে ম্যাগনাস হার্শফিল্ড সমলিঙ্গের যৌনতায় আসক্তদের মাঝে বিশেষ এক ক্ষুদ্র শ্রেনী ট্রান্সভেস্টাইট চিহ্নিত করেন যারা বিপরীত লিঙ্গের মত সাজতে পছন্দ করে, এর মাধ্যমে যৌন তৃপ্তি লাভ করেন। এদেরকে তিনি নাম দেন ট্রান্সভেস্টাইট হিসেবে (১৯১০)। এদের উল্লেখযোগ্য অংশ উভয়কামী। ক্রসড্রেসার এবং ড্র্যাগ শব্দ ট্রান্সভেস্টাইটের সমার্থক হিসেবে ধরা হয়। ট্রান্সভ্যাস্টাইটদের মধ্যে এক ক্ষুদ্র অংশ যারা সার্জারী এবং হরমোন চিকিৎসার মাধ্যমে নিজের শরীরকে স্থায়ীভাবে বিপরীত লিঙ্গের মত করতে চায়। এদেরকে চিহ্নিত করতে হার্শফিল্ড ট্রান্সসেক্সুয়াল (Transsexual) নামক পরিভাষা প্রচলন করেন যা পরবর্তীতে ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।
পশ্চিমারা হিজড়াকে ট্রান্সজেন্ডার মনে করে!
২০১৩ সালে পশ্চিমা সংস্থাগুলো হিজড়ার স্বীকৃতিকে ভূয়সী প্রশংসা করে, তারা এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার কায়েম পথ উন্মোচন হলো বলে মনে করছিলেন। ২০১৫ সালে বন্ধু সোস্যাল ঢাকায় হিজড়া প্রাইড আয়োজন করে যেখানে সমকামীদের ফ্ল্যাগ বহন করা হয়। এই প্যারেডে পশ্চিমা দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তা এবং দাতাসংস্থার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন[7]। বাংলাদেশের মত এত রক্ষণশীল দেশে এলজিবিটি প্যারেড হচ্ছে কিন্তু কেউ কিছু-ই তো বলল না; বরং এই আনন্দ শোভাযাত্রাকে সাধুবাদ জানায়। এই ঘটনা পশ্চিমা এলজিবিটি অ্যাক্টিভিস্টরা রীতিমত বিস্মিত করে! আসল কাহিনী হচ্ছে- আমাদের সমাজে হিজড়াদের লিঙ্গ প্রতিবন্ধী মনে করা হয়। তাই তাদের সামাজিক পূর্ণবাসনে সাধারন মানুষ সমর্থন করে। এই ঘটনার পর তাদের হিজড়া ‘সহানুভূতি’র আসল উদ্দেশ্য উন্মোচন হয়ে যায়।
হিজড়ার কথা বলে দেশে ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ প্রচার- ড. হোসনে-আরা কেইস
হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার দুটি যে ভিন্ন বিষয় (টার্ম) হলেও এই দুটি শব্দকে সমার্থক দেখিয়ে সমকামী তথা ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট ‘থেকে মেয়েতে রূপান্তরিত হওয়ার এই ঘটনাকে সুচতুরভাবে উল্লেখ করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এক ধরণের সিম্প্যাথী বা নৈতিক সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করে।
টিএমএসএস এনজিও প্রতিষ্ঠাতা ড. হোসনে-আরা এর উদাহরণ উপস্থাপন করে পলিসিমেকারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদেরকেও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দেয়। তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৫৩ সালে বগুড়া সদরের ঠেঙ্গামারা গ্রামে। উনাকে ছেলে সন্তান হিসেবে বড় হোন। ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সময় ২৩ বছর বয়সে শারীরিক পরিবর্তন ঘটলে তিনি অপারেশনের মাধ্যমে ছেলে আব্দুস সামাদ থেকে নারী হোসনে-আরা বেগম হয়ে এক নতুন জীবন ধারণ শুরু করেন[10]। তিনি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধু আনসার আলী তালুকদারকে বিয়ে করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে প্রফেসর আলহাজ্ব আনসার আলী তালুকদার ও অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগমের সংসারে একমাত্র পূত্র সন্তান এম আলী হায়দার রয়েছেন। পরবর্তীতে তিনি দেশের তৃতীয় বৃহৎ এনজিও (TMSS) গড়ে তুলেন।
বাস্তবতা হচ্ছে ১৯৭৫ সালে ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ বলে কিছু না। এই মুভমেন্ট লাইমলাইটে আসে ৯০’র এর দশকে। ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্বের এলজিবিটি থিংক-ট্যাংকরা মিলিত হয়ে মুভমেন্টের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা এবং এটা ‘Yogyarkarta Principles’ হিসেবে পরিচিত। এই মিটিং-এ ট্রান্সজেন্ডারের মত চরমপন্থী কনসেপ্টকে সমকামী আন্দোলনের সামনে আনার কৌশল গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালের পর থেকে ট্রান্সজেন্ডার মুভমেন্ট বেগবান হওয়া শুরু হয়। তাই যারা ড হোসেনে-আরা-বেগমকে ট্রান্সজেন্ডারের উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেন তারা এই মতবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন পাঠ্যপুস্তকে শরীফ-শরীফার বিতর্কে ট্রান্সজেন্ডাদের প্রতি নৈতিক সমর্থন তৈরী করতে ড হোসেন আরা-বেগম এর ঘটনাটি উল্লেখ করে উনার ফ্যান-ফলোয়ারদের কনফিউজড করার চেষ্টা করেন। তিনি দেশের একাডেমিশিয়ানদের মধ্যে সেলিব্রেটি ফেসবুকার। প্রফেসর মামুন সাহেবের ফেসবুক পোষ্টটির অংশ বিশেষ তুলে ধরছি-
“এবার বলুন ভার্সিটি পড়া সেই যুবক আব্দুস সামাদ সেদিন যদি তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বিচক্ষণ সিদ্ধান্তটি না নিতেন, যদি সেই নমস্য চিকিৎসক তাঁর সার্জারিটি না করতেন, যদি আব্দুস সামাদ তার পরিবর্তনের কথা সহপাঠীদের সাথে শেয়ার করতেন (অবশ্য শেয়ার না করলেও চাল চলন ও কথাবার্তার ধরণ থেকেই তা প্রকাশিত হয়ে যেত) ফলাফল কী হতো? সহপাঠীদের ঠাট্টা মশকরা বুলিং এর শিকার হয়ে ক্ষোভ লজ্জা ঘৃণায় হয়তো তাঁকে একদিন হিজড়াদের ঢেঁড়ায় গিয়ে উঠতে হতো। এবং আজও হয়তো তিনি হিজড়াদের মাসি হয়ে ঢেঁড়ায় বসে জীবন কাটাতেন। তাহলে জাতি কি পেত পঞ্চাশ লাখ মানুষের ভাগ্য বদলানোর এই মহান ব্যক্তিকে?
আমাদের চোখের সামনে আকাশ ছোঁয়া সফলতায় ভাস্বর একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরও যদি আমাদের চোখ না খুলে তাহলে বলতে হবে আমরা আসলেই একটি ব্যর্থ জাতি। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সরকারগুলির, কারণ পঞ্চাশ বছরেও তারা বিবেক সহমর্মীতা আর বোধবুদ্ধিসম্পন্ন একটি মানবিক প্রজন্ম তৈরি করতে পারেনি। মাত্র পয়তাল্লিশ পঞ্চাশ বছর পূর্বে যে রূপান্তরকে সমাজ সাদরে গ্রহণ করেছে আজ সেই রূপান্তরকে ভাবা হচ্ছে অপরাধ হিসেবে। কী বিপুল পতন আমাদের! রাস্তাঘাট ব্রীজ কালভার্টের উন্নয়নই আসল উন্নয়ন নয় মানবিক উন্নয়নটিই আসল উন্নয়ন এবং তা তৈরি করতে আমরা একশত ভাগ ব্যর্থ হয়েছি।” – আহমেদ শাহাব, ডেট্রয়েট, মিশিগান।“
আব্দুস সামাদ থেকে হোসনে-আরা হওয়া এবং এরপর সন্তানের মা হওয়া- এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় উনি ভিতরে নারী ছিলেন (জরায়ু না থাকলে সন্তান ধারণ করতে পারতেন না), কিন্তু বাইরে ছেলের মত জেনিটালিয়া ছিল। এটা নন-ক্লাসিক কনজেনিটাল এড্রেনাল হাইপারপ্লাসিয়া (CAH) অথবা এড্রোজেন সিক্রেটিং ওভারিয়ান টিউমার ছিল যার কারণে ইন্টারনাল জেনিটালিয়া ফিমেল হলেও এক্সটার্নালি ক্লাইটোরিস বড় হয়ে পেনিসের মত এবং লেবিয়া মেজোরা ফিউজড হয়ে অন্ডকোষহীন (Testisless) স্ক্রোটামের মত দেখায়। টিউমার থাকলে সার্জন তা অপসারন করে যোনি রিকনস্ট্রাকশান করে দেন, ক্লাইটোরিস থেকে অতিরিক্ত কোষ অপসারণ করে দেন। পরে তিনি সন্তান ধারণ করেন কারণ তার জরায়ু এবং ওভারি কার্যকরি ছিল। ফেসবুকের ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে বিতর্কে দেশের একজন সিনিয়র ইউরোলজিস্ট (Dr. Moudud Alamgir Pavel) এর স্ক্রিনশীট যুক্ত করে দিলাম। জন্মগত সমস্যাকে (ইন্টারসেক্স বা প্রকৃত হিজড়া) ট্রান্সজেন্ডারের (মানসিক) সাথে মিলিয়ে আবেগ তৈরীর প্রচেষ্টা একজন একাডেমিশিয়ানের কাছ থেকে কাম্য নয়।
ট্রান্সজেন্ডার/সমকামীরা কি বৈষম্যের শিকার? অধিকার বঞ্চিত?
ট্রান্সজেন্ডার/সমকামী মানুষরা সংখ্যালঘু, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, মার্জিনালাইজড সম্প্রাদায়, সুবিধাবঞ্চিত- এই শব্দগুলো বর্তমানে বেশ পরিচিত। সেকেলের ধ্যান-ধারণার কারণে সমাজ সমকামীদের অধিকার দেয় না- এই অভিযোগ সুশীল সমাজ, এনজিও, সমকামী অ্যাক্টিভিস্টরা করে থাকে। তারাও অন্য দশজনের মত মানুষ, তাদেরও ভালবাসার অধিকার আছে। ব্যাপারটি কি তাই? শুধুমাত্র সমলিঙ্গের যৌনাচারের বিষয়টি বাদ দিলে সমাজে তারা অন্যসব মানুষের মত সব অধিকার রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকুরী, নাগরিকত্ব, উত্তরাধিকার- এসব কোন কিছুর অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে না। বৈষম্যের আলোচনা তখনই আসে যখন সমকামী নামে আলাদা একটি পরিচয় তৈরীর কারণে। সহজ ভাষায়, এর মাধ্যমে সমকামীরা তাদের বিকৃত যৌন আচরনের বৈধতা চায় অর্থাৎ সামাজিকীকরণ চায়। মানুষ হিসেবে সমকামী/ট্রান্সজেন্ডাররা স্পেশাল সুবিধাভোগী হতে চায়।
চাকুরীর কোটায় সুযোগ নিতে নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার দাবী করতে উতসাহিত হবে
২০২২ সালের জনশুমারীর ফাইনাল রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে হিজড়াদের সংখ্যা মাত্র ৮ হাজার ১২৩ (বণিক বার্তা)। পুলিশের প্রতিবেদন অনুয়ায়ী ৯০% হিজড়া প্রকৃত লিঙ্গ প্রতিবন্ধী নন, অর্থাৎ নকল হিজড়া। প্রকৃত হিজড়া অর্থাৎ লিঙ্গ প্রতিবন্ধীর সংখ্যা অনেক কম। এনজিও ডেফিনেশন অনুযায়ী হিজড়া হতে হলে তাকে গুরুর অধীনে ঢেরায় বাস করে হিজড়াগিরি (ভিক্ষা) করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে হিজড়াদের উচ্চশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ সঙ্গত কারনেই কম। দেশের সাধারণ মানুষ চায় অবহেলিত হিজড়াদের পূর্নবাসিত হোক, হিজড়া কালচারের নামে দাসত্বের জীবন অবসান হোক।
কোটা সুবিধা যে সুযোগসন্ধানী ট্রান্সজেন্ডাররা ভোগ করবে তা সহজেই অনুমেয়। গণমাধ্যমে পরিচিত ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট হোচিমিন ইসলামসহ অন্যান্যরা নিজেদের তৃতীয় লিঙ্গ দাবী করে, কিন্তু তারা সবাই পুরুষ; লিঙ্গ প্রতিবন্ধী নন। অর্থাৎ তারা তৃতীয় লিঙ্গকে ট্রান্সজেন্ডার গণ্য করে। হোচিমিন পুরুষ হিসেবে বগুড়ার এক বেসরকারী নার্সিং কলেজ পড়াশুনা করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- হোচিমিনের মত পুরুষরা তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে কোটার সুযোগ নিলে কি বৈষম্য হবে না? ইতিমধ্যে হিজড়ার ব্যানারে ট্রান্সজেন্ডাররা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশীপ এবং চাকুরীতে বিশেষ সুবিধা গ্রহন করছে। তৃতীয় লিঙ্গের সংজ্ঞা আইনত স্পষ্ট না হলে অবহেলিত হিজড়ারাই বঞ্চিত হবে।
সরকারের করণীয়
বিশ্বব্যাপী জনপরিসরে যৌনতা কেন্দ্রিক আলোচনা শুরু হয়েছে মূলত ২০১০ সালের পর থেকে। শব্দের মারপ্যাঁচ হচ্ছে এলজিবিটি আন্দোলনের কৌশলের অংশ। নতুন নতুন শব্দ তৈরী হচ্ছে, এগুলোর প্রতিনিয়ত বিবর্তন হচ্ছে। পলিসিমেকারা শব্দের মারপ্যাঁচ অনুধাবন না করতে পেরে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং ফলে দেশে অহেতুক বিশৃংখলা-হানাহানি ইস্যু তৈরী হতে পারে।
প্রসংগত, পাকিস্তানে হিজড়া (খুনসা/খাজা সিরা) সম্প্রদায়কে ২০০৯ সালে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট এবং লিবারেল মিডিয়ার সহায়তায় ২০১৮ সালে ‘ট্রান্সজেন্ডার সুরক্ষা আইন’ সংসদে বিনা বিরোধিতায় পাশ হয় [11]। আইনটি পাশ হওয়ার পর যখন বিশ্ব মিডিয়া পাকিস্তানকে ট্রান্সজেন্ডার আইনটি সবচেয়ে উদারপন্থী হিসেবে ব্যাপক প্রশংসা শুরু করে, ঠিক তখনই সংসদ সদস্যদের টনক নড়ে ওঠে। এ জন্য পার্লামেন্ট মেম্বাররা অনুতপ্ত হন। লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হিজড়াদেরকে তারা মনে করেছিলেন ট্রান্সজেন্ডার। আমাদের দেশেও সিংহভাগ উচ্চশিক্ষিত মানুষ হিজড়ার ইংরেজি পরিভাষাকে ট্রান্সজেন্ডার মনে করে থাকে। অবশেষে দীর্ঘ ৫ বছর আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গত বছর (২০ মে ২০২৩) পাকিস্তানের ‘ট্রান্সজেন্ডার সুরক্ষা আইন বাতিল করে সেখানে ট্রান্সজেন্ডার শব্দের পরিবর্তে খুনসা (ইন্টারসেক্স) শব্দ যুক্ত করার আদেশ দেওয়া হয়[12]। একজন সত্যিকারে হিজরা তথা জন্মগত সমস্যা আছে কিনা তা প্রমাণে আদালত মেডিকেল টেস্ট বাধ্যতামূলক করে।
ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুর সাথে সমাজ এবং ধর্ম বিরোধী সংবেদনশীল সমকামিতার সামাজিকীকরণের বিষয়ও জড়িত রয়েছে। তাই তৃতীয় লিঙ্গের লিগ্যাল ডেফিনেশন তৈরী করা জরুরী এবং প্রকৃত হিজড়া/তৃতীয় লিঙ্গ শনাক্তকরণে মেডিকেল টেস্ট বাধ্যতামূলক করা সময়ের দাবী।
মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন, পিএইচডি
সহযোগী অধ্যাপক এবং জনস্বাস্থ্য গবেষক; লিঙ্গ রূপান্তর ফিল্ডে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিংগাপুর (NUS)-এ পিএইডি তিনি গবেষণা করেছেন
Reference
1. Rashid SF, Standing H, Mohiuddin M, Ahmed FM. Creating a public space and dialogue on sexuality and rights: a case study from Bangladesh. Health Research Policy and Systems. 2011;9: S12. doi:10.1186/1478-4505-9-S1-S12
2. Siddiqi DM. BRAC- To act or no to act ? section 377 of the Bangladesh penal code (2009-10). 2009 [cited 6 Jul 2024]. Available: http://dspace.bracu.ac.bd:8080/xmlui/handle/10361/620
3. BD S-NT. Breaking the Shame. In: Share-Net Bangladesh [Internet]. 21 Apr 2019 [cited 25 Jul 2024]. Available: https://www.share-netbangladesh.org/breaking-the-shame/
4. রূপান্তরের দ্বন্দ্ব এবং অদ্ভুত আঁধার এক! In: Bangla Tribune [Internet]. [cited 7 Jul 2024]. Available: https://shorturl.at/sGB05
5. Hossain A. Section 377, Same-sex Sexualities and the Struggle for Sexual Rights in Bangladesh. Australian Journal of Asian Law. 2019;20: 1–11.
6. Living on the extreme margin: social exclusion of the transgender population (hijra) in Bangladesh – PubMed. [cited 24 Jul 2024]. Available: https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/19761079/
7. (PDF) The paradox of recognition: hijra, third gender and sexual rights in Bangladesh | Adnan Hossain – Academia.edu. [cited 24 Jul 2024]. Available: https://www.academia.edu/34000367/The_paradox_of_recognition_hijra_third_gender_and_sexual_rights_in_Bangladesh
8. Meet Karl Heinrich Ulrichs, “the first gay person to publicly out himself.” [cited 7 Jul 2024]. Available: https://www.thepinknews.com/2021/10/11/karl-heinrich-ulrichs-gay-coming-out/
9. WashingtonPost.com: Queer Science: The Use and Abuse of Research into Homosexuality. [cited 7 Jul 2024]. Available: https://www.washingtonpost.com/wp-srv/style/longterm/books/chap1/queerscience.htm
10. Pratidin B. ৪০ বছর ধরে নারীদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ড. হোসনে-আরা. In: বাংলাদেশ প্রতিদিন [Internet]. 11 Sep 2019 [cited 7 Jul 2024]. Available: http://www.bd-pratidin.com/country/2019/09/11/456138
11. National Assembly passes bill seeking protection of transgender rights – Pakistan – DAWN.COM. [cited 6 Jul 2024]. Available: https://www.dawn.com/news/1406400
12. FSC strikes down transgender law for being ‘against Islam’ – Pakistan – DAWN.COM. [cited 6 Jul 2024]. Available: https://www.dawn.com/news/1754516/fsc-strikes-down-transgender-law-for-being-against-islam